চলচ্চিত্র: সীমানা পেরিয়ে
পরিচালক: আলমগীর কবির
গান: বিমূর্ত এই রাত্রি আমার
কণ্ঠ: আবিদা সুলতানা
কথা: শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
সুর: ভূপেন হাজারিকা

গানের কথা:
বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর
সেই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া
আছে ভালোবাসা-আদর
কামনার গোলাপ রাঙা সুন্দর এই রাত্রিতে
নীরব মনের বর্ষা আনে শ্রাবণ-ভাদর
সেই বরষায় ঝড়ো ঝরে নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া
আছে ভালোবাসা-আদর
ঝরে পড়ে ফুলের মতো মিষ্টি কথার প্রতিধ্বনি
ছড়ায় আতর, যেন ছড়ায় আতর
পরিধিহীন শঙ্কামুখী নির্মল অধর
কম্পন কাতর, কম্পন কাতর
নিয়ম ভাঙার নিয়ম এ যে।। থাক না বাধার পাথর
কোমল আঘাত প্রতি-আঘাত।। রাত্রি নিথর কাতর
দূরের আর্তনাদের নদীর ক্রন্দন কোনো ঘাটের।।
ভ্রূক্ষেপ নেই পেয়েছি আমি আলিঙ্গনের সাগর।
সেই সাগরের স্রোতেই আছে নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া
আছে ভালোবাসা-আদর।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। সেদিন মধ্যরাতে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণীঝড় আঘাত হানে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা ভোলায়।
ভোলা জেলা পুরোপুরি লন্ডভন্ড করে দেয় ‘দ্য গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’ নামের সেই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়।বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ ওই ঘূর্ণীঝড়ের প্রভাবে বিশাল উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসও হয়।
ভয়াল সেই রাতে নিহত হন পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের পানিতে গভীর সমুদ্রে ভেসে যান আরও বহু মানুষ।

সর্বনাশা ওই ঘূর্ণীঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর বরিশালের দক্ষিণে জনমানবহীন একটি সামুদ্রিক ধুধু চরে আশ্রয় নেওয়া একজোড়া মানব-মানবীর সন্ধান পাওয়া যায়।জলোচ্ছ্বাসের বানে ভেসে আসা সেই মানব-মানবী ছাড়া চরে আর কেউই ছিলেন না।
বিস্ময়কর শোনালেও, সম্পূর্ণ আদিম যুগের নর-নরীর মতোই তারা বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন সেই জনমানবহীন চরে। আদিম মানুষের মতোই মাছ শিকার করে, গাছের ফলমূল খেয়ে তারা জীবনধারণ করতে থাকেন।
বাস্তবে ঘটে যাওয়া শ্বাসরুদ্ধকর সেই ঘটনা চলচ্চিত্রের গল্পকেও যেন হার মানায়! ঘটনাটি তৎকালীন সময়ে দেশী-বিদেশী অনেক পত্র-পত্রিকায়ও ফলাও করে প্রচার হয়।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বরিশাল জেলার দক্ষিণে প্রত্যন্ত জনমানবহীন সামুদ্রিক চরে একজোড়া মানব-মানবীকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রকাশিত খবরে আরও বলা হয়, ঘূর্ণীঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াল সেই রাতে পানির তোড়ে তারা জনমানবহীন চরটিতে ভেসে গিয়েছিলেন। তারপর সেই চরে সম্পূর্ণ আদিম নর-নারীর মতো করে বেঁচে থাকার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তারা। এভাবে দিন পেরিয়ে মাস গড়ায়। কিন্তু তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে না কেউ।

প্রকাশিত খবরে এও বলা হয়, এভাবে চোখের পলকে কেটে যায় প্রায় তিন মাস। শেষ পর্যন্ত তাদের দুজনকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে লোকালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘটনাটি চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরকে ভীষণভাবে ধাক্কা দেয়। সম্পূর্ণ অন্যরকম এক দৃষ্টিতে ঘটনাটি ধরা দেয় তার কাছে।
পরবর্তী সময়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির ছায়া অবলম্বনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’ শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেন আলমগীর কবির।
দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে আলোর মুখ দেখে চলচ্চিত্র ‘সীমানা পেরিয়ে’।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন সেসময়ের তুমুল জনপ্রিয় ও শক্তিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা বুলবুল আহমেদ।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেন ‘মিস কলকাতা’ খেতাবজয়ী সুশ্রী জয়শ্রী কবির। আলমগীর কবিরের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন অসম্ভব রূপবতী এই নায়িকা।

আলমগীর কবির জানান, পত্র-পত্রিকায় ঘটনাটির বিবরণ পড়ে ভীষণ আকৃষ্ট হন তিনি। যৌনতা ও সহিংসতা ছাড়াও সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর দুজন নর-নারীর ভেতর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব কিনা তা আবিষ্কার করাই ছিল ফ্যান্টাসিধর্মী ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, এমন সম্পর্ক অসম্ভব নয়। সেটাই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন তার ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রে।
‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘বিমূর্ত এই রাত্রী আমার’ গানটি বিভিন্ন মহলের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
উপমহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতশিল্পী, সুরকার, কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক ভূপেন হাজারিকার সুরে হৃদয়স্পর্শী সুরেলা গানটি আজও শ্রোতাদের দারুণভাবে আলোড়িত করে।
‘বিমূর্ত এই রাত্রী আমার’ গানটি লেখা হয় ‘আমি এক যাযাবর’খ্যাত বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত অসমীয়া ভাষায় লেখা একটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে।
চলচ্চিত্রটিতে গান গাওয়ার পাশাপাশি সংগীত পরিচলকের আসনেও বসেন সুরসম্রাট ভূপেন হাজারিকা।
‘বিমূর্ত এই রাত্রী আমার’ গানটিতে কণ্ঠ দেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা আবিদা সুলতানা।
তখন অবশ্য তিনি আজকের মতো নাম-ডাক কামাননি। কিশোরী ছিলেন তিনি।

১৯৭৫ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রের কাজ শুরুর পরপরই ‘বিমূর্ত এই রাত্রী আমার’ গানটির শিল্পী হিসেবে আবিদা সুলতানাকে নির্বাচন করেন পরিচালক আলমগীর কবির।
তখনও কলেজের গণ্ডী পার হননি সংস্কৃতিমনা পরিবারের মেয়ে কিশোরী আবিদা সুলতানা।
ভূপেন হাজারিকার মতো ভুবনবিখ্যাত সংগীতজ্ঞের গান করার সুযোগ পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হলেও একটু ভয়ও কাজ করছিল কলেজছাত্রী আবিদার ভেতর।
পরিচালক আলমগীর কবিরের সঙ্গে কলকাতায় গানটি রেকর্ডিং করার জন্য যান কিশোরী আবিদা। তাকে দেখে শুরুতে কিছুটা চমকে যান ভূপেন হাজারিকা।
আবিদার মতো কমবয়সী মেয়ে গানটি ঠিকঠাকভাবে গাইতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে ভূপেন হাজারিকার ভেতর। তিনি নিজের ভেতরের সেই সন্দেহের কথা ভেতরে না রেখে পরিচালক আলমগীর কবিরের সঙ্গে শেয়ার করেন।
কারণ অসমীয়া কবিতা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা গানটির কথা ও সুর ভীষণ কঠিন। বিশাল ব্যাপ্তির গানটি ছোট্ট মেয়েটির কণ্ঠে ধারণ করতে পারাটা মোটেও সহজ কর্ম ছিল না।
ভূপেন হাজারিকা রাখঢাক না করে সরাসরি আবিদাকে বলে বসলেন, এত কঠিন একটি গান তিনি (আবিদা) গাইতে পারবেন কিনা।

আগপিছ কিছু না ভেবে চট করে হ্যাঁবাচক জবাব দিয়ে দিলেন আবিদা। তারপরও সংশয় কাটেনি ভূপেন হাজারিকার।
প্রথম দিন তিনি আবিদাকে গানটি শেখাননি। বরং গানটি দিয়ে তাকে অর্থ অনুধাবন করার পরামর্শ দিলেন ভূপেন হাজারিকা।
ভূপেন হাজারিকার কাছ থেকে প্রচন্ড কঠিন সেই গানটি নিয়ে সেদিনের মতো চলে গেলেন আবিদা সুলতানা।
আবিদা গভীর রাত পর্যন্ত বারবার গানটির কথা পড়লেন, বোঝার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন।
কিন্তু কঠিন সেই গানটির মর্মার্থ উদ্ধার করতে তিনি ব্যর্থ হলেন। বলা যায়, গানটি তার এন্টেনার উপর দিয়ে চলে গেলো।
গানের ‘গ’ও বুঝতে না পারলেও হাল ছাড়বার পাত্রী নন আবিদা সুলতানা। তিনি কলকাতায় যে হোটেলে উঠেছিলেন সেই হোটেলের ঘরে বসে গানটি আত্মস্থ করতে শুরু করলেন।
পাশাপাশি গানটির অর্থ গভীরভাবে বোঝার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

রাত পার করে পরদিন স্টুডিওতে গিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ গানটির রিহার্সেল করেন আবিদা সুলতানা।
এরপর বুক ধকধক করলেও সাহস করে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যান গানটির রেকর্ডিং সম্ন্ন করার উদ্দেশ্যে।
শুরু হয় গানের রেকর্ডিং। পুরোপুরি ভয় কাটিয়ে উঠতে না পারায় প্রথমবার রেকর্ডিংয়ে একটু ঘাপলা করে ফেলেন আবিদা। অবশ্য পরেরবার ঠিকঠাকমতো রেকর্ডিং সম্পন্ন করেন।
প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর গাওয়ায় রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর আবিদার কণ্ঠে গানটি শুনে ভীষণ খুশি হন ভূপেন হাজারিকা।

শুরুতে কম বয়সী আবিদা গানটি ঠিকমতো গাইতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেও রেকর্ডিং শেষে আবিদার গানের কণ্ঠের ব্যাপক প্রশংসা করেন বহু কালজয়ী গানের কারিগর ভূপেন হাজারিকা।
ভূপেন হাজারিকা নিজ হাতে আবিদার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন। এভাবেই সুরের ভুবনে আবিদাকে বরণ করে নেন সুরের ভুবনের এই মহারথী।
‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রের আরেকটি জনপ্রিয় গান ‘মেঘ থম থম করে’। চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর ‘বিমূর্ত এই রাত্রী আমার’ গানটির মতো ‘মেঘ থম থম করে’ গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
গানটিতে কণ্ঠ দেন ভূপেন হাজারিকা নিজেই। অসাধারণ কথা আর সুরের মেলবন্ধনে তৈরি গানটির আবেদন সংগীতপ্রেমীদের কাছে আজও বিন্দুমাত্র কমেনি।
১৯৯৩ সালে ‘মেঘ থম থম করে’ গানটির হিন্দি সংস্করণ ‘দিল হুম হুম কারে’ নিয়ে হাজির হন ভূপেন হাজারিকা।
দ্বৈত গানটিতে তার সঙ্গে কণ্ঠ দেন উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী। তিনি আর কেউ নন, ‘সুরের নাইটিঙ্গেল’ লতা মঙ্গেশকর।

‘রুদালি’ শিরোনামের হিন্দি চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহৃত হয়। রুপালি পর্দায় গানটির সঙ্গে ঠোঁট মেলান এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়া।
বাঙালি সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী রচিত ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘রুদালি’ চলচ্চিত্রটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়।
লেখক: তানভীর খালেক
নিউজ এডিটর, প্রথম কাগজ