তথ্য-প্রযুক্তির ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সফল প্রযুক্তি উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা হিসেবে যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হলেন স্টিভ জবস। স্টিভের পারিবারিক গ্যারেজ থেকে যাত্রা শুরু করে তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল। আইফোন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে স্মার্টফোন যুগের সূচনা করেন তিনি।
অবিবাহিত মায়ের গর্ভে জন্ম, পালক মা-বাবার কাছে বড় হওয়া, অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধ হওয়া, কোকের বোতল বিক্রি করে খাবার সংগ্রহ, আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ভারত গমন, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ, নিজ কোম্পানি অ্যাপল থেকে বিতাড়িত হওয়া ও ফিরে আসা, বান্ধবীর গর্ভে প্রথম কন্যাসন্তান, ভয়ংকর মাদক এলএসডি সেবন, ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইসহ নানা নাটকীয় অধ্যায়ে পরিপূর্ণ স্টিভের জীবন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও হার না মেনে এগিয়ে গেছেন তিনি, কাজ করেছেন দ্বিগুণ উৎসাহে। তার জীবনের গল্প থেকে শেখার আছে অনেক। এসব শিক্ষণীয় বিষয় নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারলে বদলে যেতে পারে যে কারও জীবন। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক স্টিভ জবসের প্রেরণাদায়ী সাফল্যের গল্প।
ডিজিটাল বিপ্লবের জনক বলা হয় তাকে। পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবেও বিবেচিত তিনি। অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতার বদৌলতে সুনিপুণ ও আনকোড়া ডিজাইনের নানা প্রযুক্তিপণ্য উপহার দিয়ে সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সফল এই প্রযুক্তি উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল।
স্মার্টফোনের বিস্ময় আইফোন থেকে শুরু করে আইপড, আইপ্যাড, আইটিউনস মিউজিক স্টোর, আইম্যাক, ম্যাকবুক, অ্যাপল টিভি, ক্লাউড কিংবা অ্যাপ স্টোরের মতো উদ্ভাবনগুলোকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছেন স্টিভ জবস। ২০০৭ সালে আইফোনের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়েই মূলত স্মার্টফোন যুগের সূচনা।
কেবল উদ্ভাবক নয়, নির্বাহী হিসেবেও অতুলনীয় ছিলেন স্টিভ জবস। তিনি সর্বকালের অন্যতম সৃজনশীল ও সাহসী সিইও। প্রযুক্তি পণ্যের সংজ্ঞাই যেন বদলে দিয়েছেন স্টিভ জবস। তার নকশা করা প্রযুক্তি পণ্য বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। গান, সিনেমা, গেমস, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন মিলেমিশে একাকার করার পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি স্টিভ জবস।
তার পুরো নাম স্টিভেন পল জবস। জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো শহরে। জীবনের শুরুতেই পরিচয় সঙ্কটে ভুগতে হয় লাভ চাইল্ড স্টিভকে। জন্ম দিলেও সন্তানের দেখভালের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না স্টিভের প্রকৃত বাবা-মা। স্টিভকে বেড়ে উঠতে হয় পালক সন্তান হিসেবে। অবশ্য যত্নবান পালক মা-বাবাই পান তিনি। তার পালক বাবা পেশায় ছিলেন যন্ত্র মেরামতকারী।
১৯৭২ সালে স্টিভ হাই স্কুল শেষ করে রিড কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু অর্থাভাবে কলেজ ছেড়ে দেয়ায় স্নাতক ডিগ্রি আর নেয়া হয়নি। তাছাড়া প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে মোটেও মনোযোগী ছিলেন না স্টিভ।
জীবনের কঠিন সেই সময়ের কথা জানিয়ে ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় স্টিভ বলেছিলেন, কলেজের হোস্টেলে রুম পাইনি। বন্ধুদের রুমে গিয়ে মেঝেতে ঘুমাতে হতো। কোকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে যা পেতাম তা দিয়ে খাবার কিনতাম। একটু ভালো খাবারের লোভে প্রতি রোববার রাতে সাত মাইল হেঁটে চলে যেতাম হরেকৃষ্ণ মন্দিরে।
১৯৭৩ সালে কম্পিউটার ও ভিডিও গেমস ডিভাইস তৈরির প্রতিষ্ঠান অ্যাটারিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন স্টিভ। বছর না ঘুরতেই তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ভারতে যান ও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন আশ্রম ঘুরে সাত মাস পর ভারত থেকে ফিরে ফের অ্যাটারিতে কাজ ধরেন। আর্কেড ভিডিও গেম ব্রেকআউটের জন্য সার্কিট বোর্ড তৈরির কাজ দেয়া হয় তাকে। এই কাজে তিনি সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াককে। তারা দুজন মিলে এমন দুর্ভেদ্য ডিজাইনের সার্কিট বোর্ড তৈরি করেন যে, অ্যাটারি ইঞ্জিনিয়াররা রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যান।
১৯৭৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে স্টিভ ও তার বন্ধু ওজনিয়াক মিলে ব্যবসা শুরু করেন। তারা নিজেদের কোম্পানির নাম দেন অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি। প্রথম দিকে শুধু সার্কিট বোর্ড বিক্রি করতেন তারা। লস অল্টোসে স্টিভের পারিবারিক গ্যারেজে যাত্রা শুরু করা অ্যাপল আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি।
১৯৭৭ সালে অ্যাপল কম্পিউটার ইংক হিসেবে ইনকর্পোরেটেড হয়। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝিতে অ্যাপল পণ্যের উচ্চমূল্য ও সীমাবদ্ধ সফটওয়্যার সমস্যা তৈরি করে। পাশাপাশি চলতে থাকে নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতার লড়াই। ১৯৮৫ সালে ওজনিয়াক অ্যাপল থেকে সরে দাঁড়ান। স্টিভকেও তার নিজের কোম্পানি থেকে বিতাড়িত করা হয়। অ্যাপল থেকে বের হয়ে নিজের নতুন কোম্পানি নেক্সট গঠন করেন তিনি।
পার্সোনাল কম্পিউটারের বাজার বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিযোগীদের কমদামী পণ্যের কারণে অ্যাপলের পণ্য বিক্রি কমতে থাকে। ১৯৯৬ সালে স্টিভের গড়া নেক্সট কোম্পানিকে কেনার ঘোষণা দেয় অ্যাপল। পরের বছর তত্কালীন প্রধান নির্বাহী গিল আমেলিওকে উচ্ছেদ করা হলে স্টিভের প্রত্যাবর্তন ঘটে অ্যাপলে। তার নানামুখী উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়ায় অ্যাপল। ২০০০ সালে অ্যাপলের স্থায়ী প্রধান নির্বাহী হন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনকে আড়ালে রাখার তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন স্টিভ। জীবনের অনেক কিছু গোপন রাখলেও প্রথম জীবনে এলএসডি ড্রাগ নেয়ার কথা অবশ্য আকারে-ইঙ্গিতে স্বীকার করেছেন তিনি। তার মাদক গ্রহণের প্রমাণ মেলে এলএসডির উদ্ভাবক সুইস বিজ্ঞানী আলবার্ট হফম্যানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে। এই মাদক চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য গবেষণার অর্থ চেয়ে স্টিভকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন হফম্যান। এছাড়া একটি বইয়ে স্টিভকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মাদক নেয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি এলএসডির পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন। অ্যাপলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডিজাইন তৈরিতে এই মাদক তার ভাবনায় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
স্টিভ অাধ্যাত্মবাদী ছিলেন। মাছ খেলেও, মাংস খেতেন না। প্রাচ্যের ভেষজবিদ্যায় তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হওয়া সত্ত্বেও স্টিভের বাৎসরিক বেতন ছিল মাত্র এক ডলার। এত কম বেতন নিলেও তিনি রেখে গেছেন অঢেল সম্পদ। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী তিনি। ২০১১ সালে স্টিভের মৃত্যুর সময় তার মোট সম্পদের মূল্যমান ছিল ৮৩০ কোটি ডলার। আর অ্যাপলের বাজারমূল্য ছিল ৩৫০ বিলিয়ন বা ৩৫ হাজার কোটি ডলার। ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রথম কোম্পানি হিসেবে এক ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে অ্যাপল।
দীর্ঘ সময় ধরে প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে স্টিভকে। ২০০৩ সালে জটিল প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের চিকিৎসার পাশাপাশি তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তিন বছরের মধ্যেই আবার টিউমার হয় এবং ২০০৯ সালে তার যকৃত প্রতিস্থাপন করতে হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার মাত্র ৫৬ বছর বয়সে স্টিভের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী লরেন, সন্তান রিড, এরিন, ইভ এবং স্কুলজীবনে বান্ধবীর গর্ভে জন্ম দেওয়া প্রথম কন্যা সন্তান লিসা ব্রেনানকে।
স্টিভ জবসের কাছ থেকে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে টিম কুকের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে অ্যাপল। সেই অগ্রযাত্রা থামেনি করোনাকালেও।
বেঁচে থাকতে স্টিভ জবস বলেছিলেন, আপনার সময় সীমিত, তাই অন্য কারও জীবনযাপন না করে নিজের জীবনটাই যাপন করুন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। অসাধারণ সব কাজ করুন এবং সামনে এগিয়ে যান। কোনো কাজ প্রশংসিত হলে তা নিয়ে পড়ে না থেকে এরপর কী করা যায় ভাবুন। কখনোই নিজের মতামতকে অন্যের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন না এবং আপনার ভেতরের আওয়াজ থেকে অন্যের আওয়াজ বের হতে দেবেন না। আমি ভাগ্যবান ছিলাম এই কারণে যে, মাত্র ২০ বছর বয়সেই আমি আমার ভালোলাগার কাজ খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি যেটা করতাম সেটা ভালোবাসতাম। আর এটাই আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে। আপনি কী ভালোবাসেন তা খুঁজে বের করুন। না পেলে খুঁজতেই থাকুন, থামবেন না।
লেখক : তানভীর খালেক, নিউজ এডিটর, প্রথম কাগজ
